মানসিক রোগ, বর্তমান সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা আমাদের অনেকেরই জীবনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। মানসিক রোগের প্রভাব আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে, পারিবারিক জীবনে এবং সামাজিক জীবনের উপর পরে থাকে। আমাদের চারপাশে অনেক মানুষ রয়েছে যারা প্রতিনিয়তেই এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে কিন্তু তারা বুঝতে পারে না কিভাবে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
মানসিক রোগ কি?
মানসিক রোগ হলো এমন এক ধরনের অসুস্থতা যা একজন ব্যক্তির চিন্তা, অনুভূতি এবং আচরণের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এটি একটি গুরুতর সমস্যা যা কখনও কখনও আপনার জীবনযাপনকে কঠিন করে তুলতে পারে।
মানসিক রোগের লক্ষণ
মানসিক রোগের বিভিন্ন লক্ষণ হতে পারে। তার মধ্যে কিছু লক্ষণ হলো:
- অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা।
- আত্মবিশ্বাসের অভাব।
- ঘুমের সমস্যা।
- মেজাজের পরিবর্তন।
- সমাজ ও পরিবার থেকে দূরে থাকার প্রবণতা।
- মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণ
- মানসিক রোগীর মধ্যে কিছু শারীরিক লক্ষণও দেখা যায়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেঃ
- মাথাব্যথা।
- পেটের সমস্যা।
- অতিরিক্ত ক্লান্তি।
- হার্টের ধুকপুকানি।
- খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন।
- মেজাস খিটখিটে হয়ে যাওয়া।
মানসিক রোগের কারণ
মানসিক রোগের বিভিন্ন কারণে হতে পারে যা বলা কঠিন তবে কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ হলোঃ
- জেনেটিক প্রভাবঃ পরিবারের মধ্যে কারো মানসিক রোগের ইতিহাস থাকলে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে।
- পরিবেশগত কারণঃ ছোটবেলার ঘটে যাওয়া ট্রমা, স্ট্রেসফুল পরিবেশ, সমাজের চাপ, পারিবারিক চাপ ইত্যাদি কারনেও মানসিক রোগ হতে পারে।
আরও পড়ুনঃ দাঁতের ব্যথা নিরাময়ের সহজ উপায়
মানসিক রোগ কি ভালো হয়?
মানসিক রোগ ভালো হওয়া সম্ভব, তবে এটি একটি ধৈর্য এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সঠিক চিকিৎসা ও সবার সহযোগিতা পেলে মানসিক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে এখানে পরিবারের সাপোর্ট অনেক বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। অনেক সময় পারিবারিক কারণে মানুষ মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হতে থাকে।
মানসিক রোগের চিকিৎসা
মানসিক রোগের চিকিৎসা বিভিন্ন ধরণের হতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো:
- থেরাপিঃ কগনিটিভ বিহেভিওর থেরাপি (CBT), ডায়ালেকটিক্যাল বিহেভিওর থেরাপি (DBT) ইত্যাদি। এ সকল থেরাপির মাধ্যমে মানসিক রোগীর দ্রুত সুস্থ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- ওষুধঃ মানসিক রোগীর জন্য বিভিন্ন ধরনের ঔষধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে কখনই এ সকল ঔষধ ফার্মাসি থেকে কিনে ব্যবহার করতে যাবেন না। এতে করে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। ঔষধ গ্রহনের ক্ষেত্রে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। সাধারনত যেকল ঔষধ মানসিক রোগীর জন্য ব্যবহার করা হয় তা হলোঃ অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস, অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি ওষুধ, অ্যান্টিসাইকোটিক্স ইত্যাদি।
- লাইফস্টাইল পরিবর্তনঃ লাইফস্টাইল এর পরিবর্তন মানসিক রোগীর জন্য অনেক বড় চিকিৎসা। যেমনঃ স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম ও পর্যাপ্ত ঘুম।
মানসিক রোগের ওষুধ কত দিন খেতে হয়?
সাধারণত মানসিক রোগের ওষুধ খাওয়ার সময়কাল রোগের ধরন এবং চিকিৎসার উপর নির্ভর করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানসিক রোগীকে দীর্ঘ সময় ধরে ওষুধ খেতে হয়। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বল্প সময়ের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।
সিজোফ্রেনিয়া রোগ থেকে মুক্তির উপায়
সিজোফ্রেনিয়া একটি গুরুতর মানসিক রোগ যা সঠিক চিকিৎসা এবং পারিবারিক সাপোর্টের মাধ্যমে খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এর জন্য প্রয়োজনঃ
- সঠিক ওষুধ।
- মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের নিয়মিত চেকআপ।
- পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবের সাপোর্ট।
- সর্বদা রোগীর সাথে সময় কাটানো।
- ধিরে ধিরে রোগীকে বোঝানো।
- কোন কিছুতে রোগীকে জোর না করা।
- রোগীর সাথে বন্ধু সূলভ আচরণ করা।
মানসিক চাপ থেকে মুক্তির উপায়
মানসিক চাপ, বর্তমান সময়ের আমাদের আশেপাশে থাকা প্রত্যেকটি মানুষই কোন না কোন মানসিক চাপে রয়েছে। যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। আমরা পরিবারিক, সামাজিক, অফিসিয়াল কিংবা আর্থিক এ ধরনের বিভিন্ন কারণে মানসিক চাপে থাকি। যা আমাদের মেজাজকে খিটখিটে করে তোলে। এই মানসিক চাপ আমাদের জীবকে অনেক সময় কঠিন পরিস্থিতির মুখমুখি করে তোলে। এমনকি অনেকে এই মানসিক চাপ মেনে নিতে না পেরে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে থাকে। তবে আত্মহত্যা কোন সমাধান নয় যা অনেক বড় পাপ। তাই চলুন আমরা জেনে নেই কিভাবে মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়ঃ
- মেডিটেশন কিংবা যোগব্যায়াম।
- নিয়মিত ব্যায়াম।
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস।
- পর্যাপ্ত ঘুম।
- যে কোন ধরণের সৃজনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকা।
- পরিবারের সাথে সময় কাটানো।
- সময় পেলে ঘুরতে যাওয়া।
- মাদক সেবনের অভ্যাস থাকলে তা পরিত্যাগ করা।
- ধুমপান করতে তা ত্যাগ করা।
- যে কোন গৃহপালিত পশু বা পাখি পালন করা, যাদের সাথে সময় কাটানো যায়। যেমনঃ বিড়াল, কুকুর, কবুতর, পাখি ইত্যাদি।
- রাতে দ্রুত ঘুমাতে যাওয়া ও ভোরে ঘুম থেকে উঠা।
- নিয়মিত নামাজ কিংবা প্রাথনা করা।
মানসিক রোগের তালিকা
বর্তমানে বিভিন্ন ধরণের মানসিক রোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাই মানসিক রোগের তালিকাও অনেক বড়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মানসিক রোগ হলোঃ
- ডিপ্রেশন।
- অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার।
- বাইপোলার ডিসঅর্ডার।
- সিজোফ্রেনিয়া।
- ওসিডি (অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার)।
মানসিক রোগীদের জন্য সহায়তা
আমাদের মধ্য অনেকেই রয়েছে যারা মানসিক সমস্যায় রয়েছে কিন্তু পরিবার বা সমাজে লোকলজ্জার ভয়ে মানসিক ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না। যা মোটেও উচিত নয়। কোন ধরনের মানসিক অসস্তি বোধ করলে ভাল একজন মানসিক ডাক্তার দেখাবেন। তবে আপনি চাইলে অনলাইনের মাধ্যমে ও এ সকল সেবা নিতে পারেন। মানসিক রোগীদের সহায়তার জন্য বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের এজেন্সি বা হেল্প সেন্টার রয়েছে। যেমনঃ
- কাউন্সেলিং সেন্টার।
- সাপোর্ট গ্রুপ।
- হটলাইন সেবা।
- অনলাইন থেরাপি প্ল্যাটফর্ম।
শেষ কথা
বর্তমানে মানসিক রোগ একটি গুরুতর সমস্যা যা সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা এবং সাপোর্ট পেলে নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি পুরপুরি সুস্থ হওয়া সম্ভব। আমাদের সকলের উচিত মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া। এর পাশাপাশি পরিবারের উচিত পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যর সাথে সমান সু-সম্পর্ক বজায় রাখা। এতে করে পরিবারের কেউ ডিপ্রেসনে পড়বে না। এছাড়াও আমাদের সমাজের সকলের সচেতনতা প্রয়োজন।
মানসিক রোগ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন
মানসিক রোগ কি সহজে নিরাময় হয়?
উত্তরঃ না, মানসিক রোগ সহজে নিরাময় হয়না। এটি সময়সাপেক্ষ এবং ধৈর্যের প্রয়োজন। সঠিক চিকিৎসা এবং পারিবারিক সাপোর্ট পেলে মানসিক রোগ ভালো হয়।
মানসিক রোগের চিকিৎসায় কত সময় লাগে?
উত্তরঃ এটি রোগের ধরন এবং চিকিৎসার উপর নির্ভর করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কয়েক মাস, আবার কিছু ক্ষেত্রে কয়েক বছরের বেশি সময় লাগতে পারে।
মানসিক রোগের চিকিৎসা কি সবসময় ওষুধের মাধ্যমে হয়?
উত্তরঃ না, ওষুধের পাশাপাশি থেরাপি, জীবনযাপনের পরিবর্তন এবং পারিবারিক সাপোর্ট অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
মানসিক রোগ কি পরিবারে ছড়াতে পারে?
উত্তরঃ না, তবে কিছু মানসিক রোগ জেনেটিক প্রভাবের কারণে হতে পারে।
কিভাবে মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়?
উত্তরঃ মেডিটেশন বা যোগব্যায়াম, নিয়মিত ব্যায়াম, পরিবারের সাথে সময় কাটানো এবং পর্যাপ্ত ঘুম মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে।
[…] আরো পড়ুন: মানসিক রোগ থেকে মুক্তি: লক্ষণ, চিকিৎসা… […]