আস্তাগফিরুল্লাহ দোয়া পাঠ করে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন। এর অর্থ, ফজিলত, পাঠের নিয়ম এবং গোনাহ মাফের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন।
প্রতিদিন আমরা জেনে বা না জেনে অসংখ্য ভুল ও পাপ কাজ করে থাকি। এই পাপ থেকে মুক্তি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম সেরা উপায় হলো ইস্তেগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করা। আর ইস্তেগফারের বহুল প্রচলিত ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দোয়া হলো “আস্তাগফিরুল্লাহ দোয়া”। এই আর্টিকেলে আমরা আস্তাগফিরুল্লাহ দোয়ার অর্থ, এর গুরুত্ব, ফজিলত, পাঠের নিয়ম এবং এর মাধ্যমে ক্ষমা লাভের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

Table of Contents
আস্তাগফিরুল্লাহ দোয়া কি?
‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ (أَسْتَغْفِرُ اللّٰهَ) একটি আরবি বাক্য, যার অর্থ হলো “আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি”। এটি ইসলামে ক্ষমা প্রার্থনার একটি সংক্ষিপ্ত ও শক্তিশালী রূপ। মুসলমানগণ তাদের কৃত পাপ ও ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতে এই দোয়াটি পাঠ করে থাকেন। এটি শুধুমাত্র একটি বাক্য নয়, বরং আল্লাহর প্রতি বান্দার আত্মসমর্পণ ও বিনয়ের প্রতীক।
আস্তাগফিরুল্লাহ দোয়ার অর্থ
‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ শব্দটির মূল অর্থ হলো:
- আস্তাগফিরু (أَسْتَغْفِرُ): আমি ক্ষমা চাই / আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
- আল্লাহ (اللّٰهَ): আল্লাহ (পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তা)।
সুতরাং, “আস্তাগফিরুল্লাহ” এর পূর্ণাঙ্গ অর্থ দাঁড়ায়: “আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”
এর সাথে অন্যান্য শব্দ যোগ করে দোয়াটিকে আরও বিস্তারিত করা যায়, যেমন: “আস্তাগফিরুল্লাহ ওয়া আতুবু ইলাইহি” (আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি এবং তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন করছি) অথবা “আস্তাগফিরুল্লাহাল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুম ওয়া আতুবু ইলাইহি” (আমি সেই আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি যিনি ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই, তিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী এবং আমি তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন করছি)।
আরও পড়ুনঃ আস্তাগফিরুল্লাহ দোয়া আরবি বাংলা অর্থসহ
আস্তাগফিরুল্লাহ দোয়ার গুরুত্ব ও তাৎপর্য
ইসলামে ইস্তেগফারের গুরুত্ব অপরিসীম। আস্তাগফিরুল্লাহ দোয়া পাঠের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নিকট নিজের দুর্বলতা ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করে এবং তাঁর অসীম দয়া ও ক্ষমার প্রতি আস্থা স্থাপন করে। এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য নিচে তুলে ধরা হলো:
- গোনাহ মাফ: নিয়মিত ইস্তেগফার পাঠ করলে আল্লাহ তাআলা বান্দার ছোট ও বড় গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন।
- আল্লাহর নৈকট্য লাভ: ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর অধিক নিকটবর্তী হওয়ার সুযোগ পায়।
- রিজিক বৃদ্ধি: ইস্তেগফার রিজিক ও বরকত বৃদ্ধির একটি মাধ্যম। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো, নিশ্চয়ই তিনি অতীব ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত করবেন, এবং তিনি তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা সমৃদ্ধ করবেন এবং তোমাদের জন্য উদ্যান স্থাপন করবেন ও নদীনালা প্রবাহিত করবেন।” (সূরা নূহ, আয়াত: ১০-১২)
- মানসিক প্রশান্তি: পাপের बोझ থেকে মুক্ত হয়ে মানসিক শান্তি ও স্থিরতা লাভ করা যায়।
- বিপদ থেকে মুক্তি: ইস্তেগফার বালা-মুসিবত ও বিপদ-আপদ দূর করে দেয়।
- জান্নাত লাভ: আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাইলে এবং পাপ কাজ থেকে বিরত থাকলে জান্নাত লাভের পথ সুগম হয়।
আস্তাগফিরুল্লাহ দোয়া পাঠের ফজিলত
আস্তাগফিরুল্লাহ দোয়া পাঠের অসংখ্য ফজিলত হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ফজিলত উল্লেখ করা হলো:
- রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে প্রত্যেক বিপদ থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করে দেবেন, সব ধরনের দুশ্চিন্তা থেকে নাজাত দেবেন এবং তাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দান করবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ১৫১৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ২২৩৪)
- অন্য একটি হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “আমি দৈনিক সত্তরবারের অধিক আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তওবা করি।” (সহীহ বুখারী, হাদিস: ৬৩০৭) এটি উম্মতের জন্য একটি শিক্ষা যে, নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও তিনি এতবার ইস্তেগফার করতেন।
- হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি নিজের জন্য ‘ইস্তেগফার’ (ক্ষমা প্রার্থনা) আবশ্যক করে নেবে, আল্লাহ তাআলা তাকে সব ধরনের দুশ্চিন্তা ও বিপদ থেকে মুক্তি দেবেন এবং তাকে এমন পথে রিজিক দান করবেন, যা সে কল্পনাও করতে পারবে না।” (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩৮১৯)
কখন আস্তাগফিরুল্লাহ দোয়া পাঠ করবেন?
আস্তাগফিরুল্লাহ দোয়া যেকোনো সময় পাঠ করা যায়। তবে কিছু বিশেষ সময় ও অবস্থায় এর গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়:
- প্রতি নামাজের পর: ফরজ নামাজের সালাম ফেরানোর পর তিনবার “আস্তাগফিরুল্লাহ” বলা সুন্নত।
- কোনো গুনাহ হয়ে গেলে: যখনই কোনো পাপ বা ভুল হয়ে যায়, তাৎক্ষণিকভাবে অনুতপ্ত হয়ে ইস্তেগফার করা উচিত।
- সার্বক্ষণিক: হাঁটাচলার সময়, কাজ করার সময়, অবসরে—সর্বদা আল্লাহর স্মরণে ইস্তেগফার করা উত্তম।
- শেষ রাতে (তাহাজ্জুদের সময়): রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এই সময়ে ইস্তেগফার করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ।
- বিপদ ও দুশ্চিন্তার সময়: যেকোনো বিপদ বা মানসিক অস্থিরতায় আল্লাহর সাহায্য চেয়ে ইস্তেগফার করা উচিত।
- দোয়া করার আগে: কোনো বিশেষ দোয়া করার আগে ইস্তেগফার করে নিলে দোয়া কবুল হওয়ার আশা বেশি থাকে।
বিভিন্ন প্রকার ইস্তেগফার ও সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার
ইস্তেগফারের বিভিন্ন ধরণ রয়েছে। সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত ইস্তেগফার হলো শুধু “আস্তাগফিরুল্লাহ” (আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই) বলা।
এছাড়াও আরও কিছু পরিচিত ইস্তেগফার হলো:
- “আস্তাগফিরুল্লাহ ওয়া আতুবু ইলাইহি” (أَسْتَغْفِرُ اللّٰهَ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ) – অর্থ: আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি এবং তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন করছি।
- “রাব্বিগফিরলি ওয়া তুব আলাইয়্যা, ইন্নাকা আনতাত তাওয়াবুর রাহিম” (رَبِّ اغْفِرْ لِيْ وَتُبْ عَلَيَّ إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ) – অর্থ: হে আমার রব, আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার তওবা কবুল করুন, নিশ্চয়ই আপনি তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।
সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার (ইস্তেগফারের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দোয়া)
সকল ইস্তেগফারের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো ‘সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এই দোয়াটিকে “ইস্তেগফারের নেতা” বা “শ্রেষ্ঠ ইস্তেগফার” বলে আখ্যায়িত করেছেন।
সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার দোয়াটি হলো:
اللّٰهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لَا إِلٰهَ إِلَّا أَنْتَ، خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ، وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ، أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ، أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ، وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي، فَاغْفِرْ لِي، فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা আনতা রাব্বি লা ইলাহা ইল্লা আনতা, খালাক্বতানি ওয়া আনা আব্দুকা, ওয়া আনা ‘আলা আহদিকা ওয়া ওয়া’দিকা মাসতাতা’তু। আ’উযুবিকা মিন শাররি মা সানা’তু, আবুউলাকা বিনি’মাতিকা ‘আলাইয়্যা, ওয়া আবুউলাকা বিযানবি, ফাগফিরলি ফাইন্নাহু লা ইয়াগফিরুয যুনুবা ইল্লা আনতা।
অর্থ: “হে আল্লাহ! আপনি আমার প্রতিপালক, আপনি ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং আমি আপনার বান্দা। আমি যথাসাধ্য আপনার সাথে কৃত অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির উপর প্রতিষ্ঠিত আছি। আমি আমার কৃতকর্মের অনিষ্ট থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমি আমার প্রতি আপনার নিয়ামতের স্বীকৃতি দিচ্ছি এবং আপনার নিকট আমার গুনাহের স্বীকৃতি দিচ্ছি। অতএব, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। কেননা, আপনি ছাড়া আর কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারে না।”
ফজিলত: রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে দিনের বেলায় এই দোয়া পাঠ করবে এবং সন্ধ্যার আগে মারা যাবে, সে জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর যে ব্যক্তি রাতের বেলায় এই দোয়া পাঠ করবে এবং সকাল হওয়ার আগে মারা যাবে, সেও জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সহীহ বুখারী, হাদিস: ৬৩০৬)
আস্তাগফিরুল্লাহ দোয়া পাঠের সঠিক নিয়ম ও শর্তাবলী
আস্তাগফিরুল্লাহ দোয়া বা যেকোনো ইস্তেগফার কবুল হওয়ার জন্য কিছু শর্ত ও আদব রয়েছে:
- আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা (ইখলাস): শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে, লোক দেখানোর জন্য নয়।
- অনুতপ্ত হওয়া (নাদামত): কৃত পাপের জন্য মনে মনে অনুতপ্ত ও লজ্জিত হতে হবে।
- পাপ কাজ ত্যাগ করা: যে পাপের জন্য ক্ষমা চাওয়া হচ্ছে, সেই পাপ কাজটি তাৎক্ষণিকভাবে ত্যাগ করতে হবে।
- ভবিষ্যতে গুনাহ না করার দৃঢ় সংকল্প: ভবিষ্যতে সেই পাপে আর লিপ্ত না হওয়ার জন্য মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে।
- বান্দার হক নষ্ট করে থাকলে তা পূরণ করা: যদি কারো অধিকার নষ্ট করা হয়ে থাকে বা কারো প্রতি জুলুম করা হয়ে থাকে, তবে তার হক ফিরিয়ে দেওয়া বা তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া আবশ্যক।
উপসংহার
আস্তাগফিরুল্লাহ দোয়া একটি ছোট কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী আমল। এর মাধ্যমে আমরা আল্লাহর অসীম রহমত ও ক্ষমার ছায়াতলে আশ্রয় পেতে পারি। নিয়মিত ইস্তেগফার আমাদের আত্মশুদ্ধি ঘটায়, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক মজবুত করে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ বয়ে আনে। তাই আসুন, আমরা সকলেই বেশি বেশি আস্তাগফিরুল্লাহ দোয়া পাঠ করি এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের সকলকে ক্ষমা করুন ও সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আমীন।